আমার এবং আমাদের প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর ড.মোহাম্মদ লোকমান,২৪ জুন শুক্রবার বিকেল আনুমানিক ৫ টায় আমাদের চিরতরে ছেড়ে চলে গেলেন।(ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রা-জিউন)। শুক্রবার বিকেলে টইটুম্বুর আয়োজিত বাবা দিবসের একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য আমার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলাম।পথে আমার দুই বন্ধু সংগীত শিল্পী কায়সার ইসলাম এবং সন্দ্বীপন অপেক্ষা করছে সংসদ ভবনের সামনে।ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে আসতেই এডভোকেট কামাল ভাইয়ের ফোন কল পেলাম,ভারাক্রান্ত কণ্ঠে তিনি জানালেন প্রফেসর লোকমান ভাই এইমাত্র ইন্তেকাল করেছেন। কি! আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিনা। কামাল ভাইয়ের ফোন রাখতে না রাখতেই ইবনে সিনা হাসপাতাল থেকে আজাদ এর বিধ্বস্থ কণ্ঠে ফোন-স্যার আর নেই। আমার পাশে গাড়ীতে ৩ সন্তান সহ রিজু,বৈবাহিক সূত্রে আমার স্ত্রী।স্যারের বাসা ছিল যার ছাত্রজীবনের একসময়ের নির্ভরতার ছায়া,খালাম্মার স্নেহ-মায়া-শাসনে যার আন্দোলন জীবন।সে বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে। কোন দূ:সংবাদ! আমি বেদনায় তার দিকে তাকাতে পারছিনা,মুখ নীচু করে বললাম-লোকমান চাচীর সাথে না তুমি সকাল থেকে একসাথে ছিলে?
-হ্যা,ফুলের মেলার অনুষ্ঠানে চাচী সহ সারাক্ষণই একসাথে ছিলাম,ইমরাণের বউ স্যারের নাতী-নাতনীরা সবাইতো ছিল|কেন কি হয়েছে? আমি স্যারের ইন্তেকালের কথা বলার সাথে সাথে সে আর্তনাদ করে উঠলো।অসম্ভব!
স্যারের হার্টের সমস্যা অনেক পুরোনো।ডায়েবেটিস অনেক দিনের সঙ্গী।কিন্ত্তু আজ স্যার সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ।সকালে ইমরাণ-রায়হানের সাথে নাস্তার টেবিলে একসাথে অনেক কথা বলেছেন।নাস্তা শেষে যে যার প্রোগ্রামে বেরিয়ে গেছেন যথারীতি।ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে স্যারের বোর্ড মিটিং।মিটিং শেষ করে বাসায় ফিরতেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন,বুকে তীব্র ব্যথা-সবাই দ্রুত নিয়ে গেলেন ইবনেসিনা হাসপাতালে।সেখানকার ইমার্জেন্সী বেডে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেলেন তিনি। চিন্তায় আর কিছুই আসছেনা।গাড়ী ঘুরিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে ইবনে সিনা হাসপাতালে গিয়ে পোছালাম।এরই মধ্যে মনকে অনেকভাবে শান্ত ও শক্ত করতে চেষ্টা করলাম,কিন্ত্তু পারলাম না।হাসপাতালের বারান্দায় রায়হান কে দেখেই বুক ভাঙ্গা কষ্ট কান্নার স্রোত হয়ে সব ছিন্ন-ভিন্ন করে দিল।আমি সান্তনা দিতে পারলাম না-নিজের অজান্তেই শিশু হয়ে গেলাম।আমার অবোধ তিন সন্তান ফ্যাল-ফ্যাল করে আমাকে দেখছে। আমার স্যার,আমার স্যার,স্যার-আর কিছুই মুখে আসছেনা আমার। কি সুন্দর মিষ্টি হাসি মুখে নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন।এর আগে বেশ ক’বার স্যার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।হাসপাতাল থেকে আমাকে একবার দেখার জন্য খবরও পাঠিয়েছিলেন।কিন্ত্তু দূর্ভাগ্য আমার, বছরে কিছুদিন পর পর হাসপাতাল-বাস আমার জীবনেরও রুটিন হয়ে গেছে। সে সময়ে আমিও তার মত অন্য একটি হাসপাতালে শুয়েছিলাম।শুয়ে শুয়ে মর্মবেদনা হচ্ছিল,যদি স্যারকে আর না দেখি!
স্যার সে যাত্রায় সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন।আবার ছড়িয়েছিলেন স্বভাব-সুলভ মমতার পরশ। আজ কত কথা মনে পড়ছে-দক্ষিণ ক্যম্পাসে আমাদের দু’টি নিবিড় ঠিকানা ছিল,লোকমান স্যার-হারুন স্যারের বাসা। রাত-বিরাত,সময়-অসময়,সুখ-শংকা’য় যখন-তখন ফোন। ঈদে ক্যম্পাস ছেড়ে সবাই যখন আনন্দ ভাগা-ভাগি করতে মা-বাবার কাছে যেত,আমরা যেতাম না।যেতে পারতাম না।আমরা দল বেধে যেতাম লোকমান স্যার-হারুন স্যার-বদিউল আলম স্যার বা ছন্দা আপার বাসায়।ঈদে আমরা তাদের বাসার প্রধান অতিথি।তাদের কাছে ইমরান-রায়হান-মামুন-ফাহিমা যেমন মন্জু-হান্নান-তোওফিক-দিদার-জাহেদ একই রকম। বাসায়,মেডিকেল সেন্টারের পুরোনো ডিপার্টমেন্টে নিজের রুম,একাডেমিক ভবন,সেন্ট্রাল মসজিদ,দক্ষিণ ক্যম্পাস মসজিদ-কত স্মৃতি।প্রয়োজনীয় উপদেশ।অবিভাবকসুলভ বন্ধুত্ব।দৃষ্টির সীমানায় নির্যাতন-নীপিড়নে মজলুম আত্মায় একাত্ম হওয়া। স্যার যখন ঢাকায় এলেন আমিও ঢাকায়।আই-আই-ইউ-সি তে নিজের চেম্বারে কত একান্ত আলাপ,ব্যক্তিগত সাংগঠনিক কত খুনসুটি।কিং ফয়সল বিশ্ববিদ্যালয় করা নিয়ে কত স্বপ্ন।স্যার বড় বড় চিন্তা করতেন।তাই তার বিচরণ ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে চট্টগ্রাম শহর-ঢাকা-ঢাকার বাইরে-বিশ্বময়। আমরা ভুল বুঝতাম,অভিমাণ করতাম।প্রয়োজনের সময় ছায়া না পেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নি:শব্দে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতাম।পরক্ষণে বুঝতাম বটবৃক্ষ শুধু ছায়া দেয় না, দুর থেকে ডাল-পালা-ছড়িয়ে অফুরন্ত জীবনী শক্তি জোগায়-নির্মল নি:শ্বাসের জন্য সীমাহীন বিশুদ্ধ বায়ু’র জন্ম দেয়।আজ আমাদের মনভাঙ্গা কান্না।সবার হৃদয়ে অন্যরকম শুন্যতা। ফোন করে টেলিভিশন টিকারে নিউজ দিতে বললাম।এনটিভি,নিউজ টুয়েন্টি ফোর এর ফাহিম,প্রথম আলো-র বুলবুল ভাইকে ফোন করলাম।মুহুর্তে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো বেদনার শিহরণ।আমি আর কল রিসিভ করতে পারছিনা। চট্টগ্রাম থেকে শামীম ভাই,মাহবুব ভাই,শামসু ভাই ফোন করে অনেকটা নির্দেশের সূরে বললেন স্যার কে শেষবারের জন্য অবশ্যই চট্টগ্রাম আনতে হবে।যা করা দরকার করতে হবে।কোন কথা শুনতে চাইনা।
বিপদে পড়লাম।রাত নয়টায় ধানমন্ডি ঈদগাহ মাঠে জানাজা এবং কাল সকালে ফেনীতে জানাজার সময় জানিয়ে মাইকিং হয়ে গেছে।খালাম্মা আমার সামনেই হাসপাতালে জ্ঞান হারিয়েছেন,তার প্রেসার খুব হাই হয়ে গেছে।এখন কিভাবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তণ হবে।আল্লাহর কাছে মনে মনে দোয়া করলাম।নিজেরও মন বলছে যে বিশ্ববিদ্যালয় স্যার নিজ হাতে গড়েছেন।যে জারুল বনের বাতাস গায়ে মেখে যুবক লোকমান প্রফেসর ড.লোকমান হয়েছেন সেখানে তার কফিন যাবেনা?আমি ক্যম্পাসে থাকলে আমিওতো মানতে পারতামনা।স্যারের কফিন নিয়ে গোসল দিতে গেছেন ইসলামী ব্যাংকের ডিরেক্টর শামসুল হুদা ভাই।তাকে ফোন করলাম তিনি সম্মত হলেন।ইমরাণ-রায়হান এত বড় হয়েছে অথচ এখনো যেন ওরা মুখের ওপর কথা বলতে শিখেনি।সাহস করে সিদ্ধান্ত নেয়া হল।খালাম্মা কে আমরা ভয় পেতাম-সমীহ করতাম কিন্ত্তু ওনার ভালোবাসার বিস্তৃতি জীবনে বহুবার টের পেয়েছি।আজ আবারো পেলাম-তিনি অমত করলেন না।সবকিছু নতুন করে আবার ঠিক করা হলো।চট্টগ্রামে ৩ টি জানাজা হবে।সকাল ৭টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে,৯টায় শহরের প্যারেড মাঠে,১১টায় আই,আই,ইউ,সি কুমিরা ক্যাম্পাসে এবং সবশেষে বিকেল ৩টায় নিজ গ্রামের ফুলগাজী পাইলট হাইস্কুল মাঠে।
রাত ৯টার প্রথম জানাজায় ঢাকার ধানমন্ডি ঈদগাহ মাঠ লোকে লোকারন্য।এত অল্প সময়ে কে আসেনি।যে শুনেছে সে ছুটে এসেছে এখানে।মিডিয়া কত বড় শক্তি,মনে মনে অনুভব করলাম আবারও।আলো-আধারীর বিশাল জানাজায় ভারপ্রাপ্ত আমীরে জামায়াত এবং ইমরাণ সবার কাছে দোয়া চাইলেন।জানাজা পড়ালেন মাওলানা একেএম ইউসুফ সাহেব। স্যারের কফিন এখন সুন্দর ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম পোছানো একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ।যারা মনের আকুলতা নিয়ে শেষবারের মত এসেছিল ধীরে ধীরে সবাই বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। আমার ভাই মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন আর কামরুল ইসলাম আজাদ মিলে অনেক কষ্টে অসাধ্য সাধন করলো।সবোর্চ্চ বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় কফিন হিমায়িত করে রাত ১১.৪৫ মিনিটে সবাই যাবার জন্য প্রস্ত্তুত। মনটা হু-হু করে উঠলো।মাত্র ৭টি ঘন্টা।বিকেল ৫টা-১২টা এরই মধ্যে সব শেষ। আর দেখা হবেনা স্যার?সেই মৃদু হাসি মাখা মুখ।
স্যার মাঝে মাঝে আদর করে লিডার বলে ডাকতেন-তার একটি বিশেষ ভঙ্গী ছিল।স্নেহ-সম্মান-মমতার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ।আর কে ডাকবে এমন করে?কেউ না, পৃথিবীর আর কোন মায়াবী মানব আমার স্যারের মত করে ভালবাসবে না। আমার চোখে শুধু নোনাজলের ধারা,হৃদয়ে বিধ্ধস্থ কম্পন। শবযাত্রা প্রস্ত্তুত।একে একে সবাই গাড়ীতে উঠছে।ধানমন্ডি থানা আমীর আমার শ্রদ্ধেয় প্রিয়জন হেমায়েত ভাই আমার হাত ধরে আছেন।তিনি শুধু বললেন যারা চলে যাচ্ছে তাদের কি কোন রিপ্রেসমেন্ট হবে এ আন্দোলনে?তার প্রশ্নের কোন জবাব নেই আমার কাছে।আমার আছে অথৈ বেদনা।যে বেদনা শুধু নি:শব্দ কান্না হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে অজান্তে। রাত গভীর ১২ টা ছুই-ছুই। রিজু তার তিন সন্তান নিয়ে আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে।কানের কাছে আমি তার দীর্ঘশ্বাসের তপ্ত তরঙ্গ অনুভব করলাম, সাথে একটি বাক্য-লোকমান স্যার নামক একটি অধ্যায় কি তাহলে শেষ? আমি জানি সে কত নির্মম একটি সত্য কথা বলছে।প্রতিদিন এক একটি করে বাতি নিভবে কিন্ত্তু আরেকটি বাতি জ্বলবেনা।যেটা জ্বলবে সেটা নিজের জন্য জ্বলবে।আমার বা আমাদের জন্য জ্বলবেনা।প্রফেসর লোকমান খুব সাধারণ একজন মানুষ,অথচ তার কাজের ব্যাপ্তি কত দুর-দুরান্তে ছড়িয়ে গেছে।
মহান আল্লাহ আমাদের কে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যান একসাথে চাইতে বলেছেন।আমরা অনেকেই তা চাই,কিন্ত্তু কেউই কি পাই?কি আশ্চর্য! আমার স্যার সেটা পেয়েছিলেন। স্যারের ৫টি সন্তান।বড় মেয়ে সালমা আপা,তার হাসবেন্ড আরমান ভাই সহ ইউএসএ তে,ফাহিমা শওকত ভাই সহ লন্ডনে সেটেল্ড।বড় ছেলে ইমরাণ আইআইইউসি তে এবং রায়হান ইউজিসিতে লেকচারার,পিচ্চি নাদিমা এখন এমবিবিএস শেষ করে ডাক্তার হতে যাচ্ছে।সবাই মেধাবী,সবাই সফল আবার সবাই ইসলামী আন্দোলনে নিবেদিত প্রাণ।জীবন ও আন্দোলন তাদের কাছে একাকার।স্যার তার সন্তানদের সবাইকে দ্বীন শিখিয়েছেন,দ্বীনের পথ মজবুত ভাবে আকড়ে ধরে বৈষয়িক জীবনে মাথা উচু করে দাড়ানোর পথ দেখিয়েছেন।আজ তার দায়িত্ব শেষ,তাই তিনি হাসতে হাসতে চলে গেলেন।একজন মানুষের জন্য ৫টি জানাজা,সবখানে সহস্র ভালোবাসার সম্মিলন।পার্থিব দৃষ্টিতে কতইনা ঈর্ষণীয় মানুষ তিনি।আমরা যারা তার কাছের কেবল তারাই অনুভব করতে পারি ইসলাম তার জীবনে কত মূর্ত ছিল। সবকিছুর পরও একটি ক্ষত আজ মনের মধ্যে খচ্ খচ্ করছে।সালমা আপা,ফাহিমা,আরমান ভাই,শওকত ভাই আজ পাশে থাকতে পারলেননা।দূ:খ সাগরে একসাথে সব ভাই-বোনেরা মিলে একাকার হতে পারলাম না।দুটি বোন দুর দুরান্ত থেকে কতইনা কষ্ট পাচ্ছে।পৃথিবীর কোন ভাষা কি তা অনুভব করতে পারে? পারেনা। স্যার আমাদের কি শিখিয়ে গেলেন? স্যার শিখালেন দ্বীনের জন্য নিজকে একাকার করে দিলে দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা অবশ্যই পাওয়া সম্ভব।হে আল্লাহ তুমি আমার স্যার কে জান্নাতের সবোর্চ্চ মর্যাদায় আসীন রেখো—আমীন।