প্রফেসর ড. মোহাম্মদ লোকমান:পার্থিব ও পরকালীন কল্যানের আদর্শে সমুজ্বল পুরুষ

lonly_0

আমার এবং আমাদের প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর ড.মোহাম্মদ লোকমান,২৪ জুন শুক্রবার বিকেল আনুমানিক ৫ টায় আমাদের চিরতরে ছেড়ে চলে গেলেন।(ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রা-জিউন)। শুক্রবার বিকেলে টইটুম্বুর আয়োজিত বাবা দিবসের একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য আমার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলাম।পথে আমার দুই বন্ধু সংগীত শিল্পী কায়সার ইসলাম এবং সন্দ্বীপন অপেক্ষা করছে সংসদ ভবনের সামনে।ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে আসতেই এডভোকেট কামাল ভাইয়ের ফোন কল পেলাম,ভারাক্রান্ত কণ্ঠে তিনি জানালেন প্রফেসর লোকমান ভাই এইমাত্র ইন্তেকাল করেছেন। কি! আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিনা। কামাল ভাইয়ের ফোন রাখতে না রাখতেই ইবনে সিনা হাসপাতাল থেকে আজাদ এর বিধ্বস্থ কণ্ঠে ফোন-স্যার আর নেই। আমার পাশে গাড়ীতে ৩ সন্তান সহ রিজু,বৈবাহিক সূত্রে আমার স্ত্রী।স্যারের বাসা ছিল যার ছাত্রজীবনের একসময়ের নির্ভরতার ছায়া,খালাম্মার স্নেহ-মায়া-শাসনে যার আন্দোলন জীবন।সে বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে। কোন দূ:সংবাদ! আমি বেদনায় তার দিকে তাকাতে পারছিনা,মুখ নীচু করে বললাম-লোকমান চাচীর সাথে না তুমি সকাল থেকে একসাথে ছিলে?

-হ্যা,ফুলের মেলার অনুষ্ঠানে চাচী সহ সারাক্ষণই একসাথে ছিলাম,ইমরাণের বউ স্যারের নাতী-নাতনীরা সবাইতো ছিল|কেন কি হয়েছে? আমি স্যারের ইন্তেকালের কথা বলার সাথে সাথে সে আর্তনাদ করে উঠলো।অসম্ভব!

স্যারের হার্টের সমস্যা অনেক পুরোনো।ডায়েবেটিস অনেক দিনের সঙ্গী।কিন্ত্তু আজ স্যার সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ।সকালে ইমরাণ-রায়হানের  সাথে নাস্তার টেবিলে একসাথে অনেক কথা বলেছেন।নাস্তা শেষে যে যার প্রোগ্রামে বেরিয়ে গেছেন যথারীতি।ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে স্যারের বোর্ড মিটিং।মিটিং শেষ করে বাসায় ফিরতেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন,বুকে তীব্র ব্যথা-সবাই দ্রুত নিয়ে গেলেন ইবনেসিনা হাসপাতালে।সেখানকার ইমার্জেন্সী বেডে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেলেন তিনি। চিন্তায় আর কিছুই আসছেনা।গাড়ী ঘুরিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে ইবনে সিনা হাসপাতালে গিয়ে পোছালাম।এরই মধ্যে মনকে অনেকভাবে শান্ত ও শক্ত করতে চেষ্টা করলাম,কিন্ত্তু পারলাম না।হাসপাতালের বারান্দায় রায়হান কে দেখেই বুক ভাঙ্গা কষ্ট কান্নার স্রোত হয়ে সব ছিন্ন-ভিন্ন করে দিল।আমি সান্তনা দিতে পারলাম না-নিজের অজান্তেই শিশু হয়ে গেলাম।আমার অবোধ তিন সন্তান ফ্যাল-ফ্যাল করে আমাকে দেখছে। আমার স্যার,আমার স্যার,স্যার-আর কিছুই মুখে আসছেনা আমার। কি সুন্দর মিষ্টি হাসি মুখে নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন।এর আগে বেশ ক’বার স্যার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।হাসপাতাল থেকে আমাকে একবার দেখার জন্য খবরও পাঠিয়েছিলেন।কিন্ত্তু দূর্ভাগ্য আমার, বছরে কিছুদিন পর পর হাসপাতাল-বাস আমার জীবনেরও রুটিন হয়ে গেছে। সে সময়ে আমিও তার মত অন্য একটি হাসপাতালে শুয়েছিলাম।শুয়ে শুয়ে মর্মবেদনা হচ্ছিল,যদি স্যারকে আর না দেখি!

স্যার সে যাত্রায় সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন।আবার ছড়িয়েছিলেন স্বভাব-সুলভ মমতার পরশ। আজ কত কথা মনে পড়ছে-দক্ষিণ ক্যম্পাসে আমাদের দু’টি নিবিড় ঠিকানা ছিল,লোকমান স্যার-হারুন স্যারের বাসা। রাত-বিরাত,সময়-অসময়,সুখ-শংকা’য় যখন-তখন ফোন। ঈদে ক্যম্পাস ছেড়ে সবাই যখন আনন্দ ভাগা-ভাগি করতে মা-বাবার কাছে যেত,আমরা যেতাম না।যেতে পারতাম না।আমরা দল বেধে যেতাম লোকমান স্যার-হারুন স্যার-বদিউল আলম স্যার বা ছন্দা আপার বাসায়।ঈদে আমরা তাদের বাসার প্রধান অতিথি।তাদের কাছে ইমরান-রায়হান-মামুন-ফাহিমা যেমন মন্জু-হান্নান-তোওফিক-দিদার-জাহেদ একই রকম। বাসায়,মেডিকেল সেন্টারের পুরোনো ডিপার্টমেন্টে নিজের রুম,একাডেমিক ভবন,সেন্ট্রাল মসজিদ,দক্ষিণ ক্যম্পাস মসজিদ-কত স্মৃতি।প্রয়োজনীয় উপদেশ।অবিভাবকসুলভ বন্ধুত্ব।দৃষ্টির সীমানায় নির্যাতন-নীপিড়নে মজলুম আত্মায় একাত্ম হওয়া। স্যার যখন ঢাকায় এলেন আমিও ঢাকায়।আই-আই-ইউ-সি তে নিজের চেম্বারে কত একান্ত আলাপ,ব্যক্তিগত সাংগঠনিক কত খুনসুটি।কিং ফয়সল বিশ্ববিদ্যালয় করা নিয়ে কত স্বপ্ন।স্যার বড় বড় চিন্তা করতেন।তাই তার বিচরণ ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে চট্টগ্রাম শহর-ঢাকা-ঢাকার বাইরে-বিশ্বময়। আমরা ভুল বুঝতাম,অভিমাণ করতাম।প্রয়োজনের সময় ছায়া না পেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নি:শব্দে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতাম।পরক্ষণে বুঝতাম বটবৃক্ষ শুধু ছায়া দেয় না, দুর থেকে ডাল-পালা-ছড়িয়ে অফুরন্ত জীবনী শক্তি জোগায়-নির্মল নি:শ্বাসের জন্য সীমাহীন বিশুদ্ধ বায়ু’র জন্ম দেয়।আজ আমাদের মনভাঙ্গা কান্না।সবার হৃদয়ে অন্যরকম শুন্যতা। ফোন করে টেলিভিশন টিকারে নিউজ দিতে বললাম।এনটিভি,নিউজ টুয়েন্টি ফোর এর ফাহিম,প্রথম আলো-র বুলবুল ভাইকে ফোন করলাম।মুহুর্তে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো বেদনার শিহরণ।আমি আর কল রিসিভ করতে পারছিনা। চট্টগ্রাম থেকে শামীম ভাই,মাহবুব ভাই,শামসু ভাই ফোন করে অনেকটা নির্দেশের সূরে বললেন স্যার কে শেষবারের জন্য অবশ্যই চট্টগ্রাম আনতে হবে।যা করা দরকার করতে হবে।কোন কথা শুনতে চাইনা।

বিপদে পড়লাম।রাত নয়টায় ধানমন্ডি ঈদগাহ মাঠে জানাজা এবং কাল সকালে ফেনীতে জানাজার সময় জানিয়ে মাইকিং হয়ে গেছে।খালাম্মা আমার সামনেই হাসপাতালে জ্ঞান হারিয়েছেন,তার প্রেসার খুব হাই হয়ে গেছে।এখন কিভাবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তণ হবে।আল্লাহর কাছে মনে মনে দোয়া করলাম।নিজেরও মন বলছে যে বিশ্ববিদ্যালয় স্যার নিজ হাতে গড়েছেন।যে জারুল বনের বাতাস গায়ে মেখে যুবক লোকমান প্রফেসর ড.লোকমান হয়েছেন সেখানে তার কফিন যাবেনা?আমি ক্যম্পাসে থাকলে আমিওতো মানতে পারতামনা।স্যারের কফিন নিয়ে গোসল দিতে গেছেন ইসলামী ব্যাংকের ডিরেক্টর শামসুল হুদা ভাই।তাকে ফোন করলাম তিনি সম্মত হলেন।ইমরাণ-রায়হান এত বড় হয়েছে অথচ এখনো যেন ওরা মুখের ওপর কথা বলতে শিখেনি।সাহস করে সিদ্ধান্ত নেয়া হল।খালাম্মা কে আমরা ভয় পেতাম-সমীহ করতাম কিন্ত্তু ওনার ভালোবাসার বিস্তৃতি জীবনে বহুবার টের পেয়েছি।আজ আবারো পেলাম-তিনি অমত করলেন না।সবকিছু নতুন করে আবার ঠিক করা হলো।চট্টগ্রামে ৩ টি জানাজা হবে।সকাল ৭টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে,৯টায় শহরের প্যারেড মাঠে,১১টায় আই,আই,ইউ,সি কুমিরা ক্যাম্পাসে এবং সবশেষে বিকেল ৩টায় নিজ গ্রামের ফুলগাজী পাইলট হাইস্কুল মাঠে।

রাত ৯টার প্রথম জানাজায় ঢাকার ধানমন্ডি ঈদগাহ মাঠ লোকে লোকারন্য।এত অল্প সময়ে কে আসেনি।যে শুনেছে সে ছুটে এসেছে এখানে।মিডিয়া কত বড় শক্তি,মনে মনে অনুভব করলাম আবারও।আলো-আধারীর বিশাল জানাজায় ভারপ্রাপ্ত আমীরে জামায়াত এবং ইমরাণ সবার কাছে দোয়া চাইলেন।জানাজা পড়ালেন মাওলানা একেএম ইউসুফ সাহেব। স্যারের কফিন এখন সুন্দর ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম পোছানো একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ।যারা মনের আকুলতা নিয়ে শেষবারের মত এসেছিল ধীরে ধীরে সবাই বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। আমার ভাই মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন আর কামরুল ইসলাম আজাদ মিলে অনেক কষ্টে অসাধ্য সাধন করলো।সবোর্চ্চ বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় কফিন হিমায়িত করে রাত ১১.৪৫ মিনিটে সবাই যাবার জন্য প্রস্ত্তুত। মনটা হু-হু করে উঠলো।মাত্র ৭টি ঘন্টা।বিকেল ৫টা-১২টা এরই মধ্যে সব শেষ। আর দেখা হবেনা স্যার?সেই মৃদু হাসি মাখা মুখ।

স্যার মাঝে মাঝে আদর করে লিডার বলে ডাকতেন-তার একটি বিশেষ ভঙ্গী ছিল।স্নেহ-সম্মান-মমতার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ।আর কে ডাকবে এমন করে?কেউ না, পৃথিবীর আর কোন মায়াবী মানব আমার স্যারের মত করে ভালবাসবে না। আমার চোখে শুধু নোনাজলের ধারা,হৃদয়ে বিধ্ধস্থ কম্পন। শবযাত্রা প্রস্ত্তুত।একে একে সবাই গাড়ীতে উঠছে।ধানমন্ডি থানা আমীর আমার শ্রদ্ধেয় প্রিয়জন হেমায়েত ভাই আমার হাত ধরে আছেন।তিনি শুধু বললেন যারা চলে যাচ্ছে তাদের কি কোন রিপ্রেসমেন্ট হবে এ আন্দোলনে?তার প্রশ্নের কোন জবাব নেই আমার কাছে।আমার আছে অথৈ বেদনা।যে বেদনা শুধু নি:শব্দ কান্না হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে অজান্তে। রাত গভীর ১২ টা ছুই-ছুই। রিজু তার তিন সন্তান নিয়ে আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে।কানের কাছে আমি তার দীর্ঘশ্বাসের তপ্ত তরঙ্গ অনুভব করলাম, সাথে একটি বাক্য-লোকমান স্যার নামক একটি অধ্যায় কি তাহলে শেষ? আমি জানি সে কত নির্মম একটি সত্য কথা বলছে।প্রতিদিন এক একটি করে বাতি নিভবে কিন্ত্তু আরেকটি বাতি জ্বলবেনা।যেটা জ্বলবে সেটা নিজের জন্য জ্বলবে।আমার বা আমাদের জন্য জ্বলবেনা।প্রফেসর লোকমান খুব সাধারণ একজন মানুষ,অথচ তার কাজের ব্যাপ্তি কত দুর-দুরান্তে ছড়িয়ে গেছে।

মহান আল্লাহ আমাদের কে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যান একসাথে চাইতে বলেছেন।আমরা অনেকেই তা চাই,কিন্ত্তু কেউই কি পাই?কি আশ্চর্য! আমার স্যার সেটা পেয়েছিলেন। স্যারের ৫টি সন্তান।বড় মেয়ে সালমা আপা,তার হাসবেন্ড আরমান ভাই সহ ইউএসএ তে,ফাহিমা শওকত ভাই সহ লন্ডনে সেটেল্ড।বড় ছেলে ইমরাণ আইআইইউসি তে এবং রায়হান ইউজিসিতে লেকচারার,পিচ্চি নাদিমা এখন এমবিবিএস শেষ করে ডাক্তার হতে যাচ্ছে।সবাই মেধাবী,সবাই সফল আবার সবাই ইসলামী আন্দোলনে নিবেদিত প্রাণ।জীবন ও আন্দোলন তাদের কাছে একাকার।স্যার তার সন্তানদের সবাইকে দ্বীন শিখিয়েছেন,দ্বীনের পথ মজবুত ভাবে আকড়ে ধরে বৈষয়িক জীবনে মাথা উচু করে দাড়ানোর পথ দেখিয়েছেন।আজ তার দায়িত্ব শেষ,তাই তিনি হাসতে হাসতে চলে গেলেন।একজন মানুষের জন্য ৫টি জানাজা,সবখানে সহস্র ভালোবাসার সম্মিলন।পার্থিব দৃষ্টিতে কতইনা ঈর্ষণীয় মানুষ তিনি।আমরা যারা তার কাছের কেবল তারাই অনুভব করতে পারি ইসলাম তার জীবনে কত মূর্ত ছিল। সবকিছুর পরও একটি ক্ষত আজ মনের মধ্যে খচ্ খচ্ করছে।সালমা আপা,ফাহিমা,আরমান ভাই,শওকত ভাই আজ পাশে থাকতে পারলেননা।দূ:খ সাগরে একসাথে সব ভাই-বোনেরা মিলে একাকার হতে পারলাম না।দুটি বোন দুর দুরান্ত থেকে কতইনা কষ্ট পাচ্ছে।পৃথিবীর কোন ভাষা কি তা অনুভব করতে পারে? পারেনা। স্যার আমাদের কি শিখিয়ে গেলেন? স্যার শিখালেন দ্বীনের জন্য নিজকে একাকার করে দিলে দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা অবশ্যই পাওয়া সম্ভব।হে আল্লাহ তুমি আমার স্যার কে জান্নাতের সবোর্চ্চ মর্যাদায় আসীন রেখো—আমীন।

হুমায়ুন আহমেদ! কিছু স্মৃতি ও শুভ কামনা।

মজিবুর রহমান মন্জু, ২০ জুলাই, শুক্রবার

Humayun_ahmed_writter

 

 

 

হুমায়ুন আহমেদ, নিজ কল্পনার আয়নায় যিনি বাদশাহ নামদার। অগণিত জনের একান্ত প্রিয় একজন মানুষ। তিনি আর নেই। চিরকালের জন্য ছেড়ে গেছেন আমাদের। একজন অসাধারণ মানুষের সগৌরব প্রস্থান। অনেক দিন থেকে তিনি জানান দিয়ে, আমাদেরকে মানসিক ভাবে প্রস্ত্তুত করে তারপর পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। যাবার আগে একবার নিজ দেশ, জন্মদাত্রী মা, এবং সকল শুভাকাংখীদের দেখে গেলেন দু’চোখ ভরে। শেষবার দেশে আসার পর,(মাস খানেক আগে)যখন দেয়াল উপন্যাস নিয়ে বেশ বিতর্ক হল তখন আমার সৌভাগ্য হয়েছে তার একটি টেলিফোন কল পাওয়ার। তাই কিছুতেই কষ্ট থামাতে পারছিনা। এখনো যেন কানে ভাসছে সে সহজ-সরল কথোপোকথন। সাহিত্যের মানুষ না হয়েও যিনি বাংলা সাহিত্যের পরম বন্ধু, কালের সম্রাট। বাংলাদেশে কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যের আধিপত্য ম্লান করে দিয়ে যিনি গল্প ও সাহিত্য প্রেমিক তরুণ-যুবা দের নিজ দেশের বই পড়ার আকর্ষণ তৈরী করেছেন। তাকে যারা পছন্দ-কিংবা অপছন্দ করেন, সম্ভবত: সবাই আজ খুব ব্যথিত। শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আহমেদ হাসতে হাসতে গেছেন কিনা জানিনা, তবে যাবার সময় তিনি সবাইকে কাদিয়েছেন। স্যার কে ঘিরে অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে আজ। বেশ কয়েক বছর আগে এক রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে হুমায়ুন আহমেদের বাসায় গিয়েছিলাম ঈদুল ফিতরের একটি নাটক প্রসঙ্গে আলাপের জন্য। আমার যে পরিচয় তাতে তিনি সহজাত স্বচ্ছন্দে তার বাসভবনে আমাকে গ্রহণ করার কথা নয়, প্রথমাবস্থায় করেন-ও নি। শুরুতেই তার তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞামূলক অভিব্যক্তি প্রকাশ পেল এবং তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন ঈদের নাটকে তিনি সহযোগিতা করবেন না। আমরা ছিলাম ৩জন। আমি, বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের বিখ্যাত মানুষ-কীর্তিমান কবি ও সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় মাহবুবুল আলম গোরা এবং জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী স্যারের স্নেহধন্য ডা: এজাজ। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত শ্রদ্ধেয় মাহবুব ভাইয়ের সৌজন্যে হুমায়ুন স্যার আমাদের বেশ গুরুত্ত্ব দিলেন এবং একপর্যায়ে গল্প খুব জমে উঠেলো। সেদিনই টের পেলাম হুমায়ুন আহমেদ কত আড্ডাপ্রিয় একজন মানুষ। আমাদের আড্ডায় একপর্যায়ে শামীল হলেন স্যারের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন-ও। সেদিনের সেই কথপোকথন, নানা মজার আলোচনা আমি কখনো ভুলবোনা। হুমায়ুন স্যার সেদিন(সম্ভবত: আমাকে দেখে) ইসলাম সম্পর্কে কনফিউশন(সংশয়) সৃষ্টি করতে পারে এমন বিষয়গুলো নিয়েই বেশী আলোচনা করলেন। তিনি যে কত প্রাজ্ঞ এবং বৈচিত্রময় জ্ঞানের ভান্ডার তা বাস্তবে অনুভব করলাম। আলোচনা অতি প্রাকৃতিক বিষয় থেকে গভীর দর্শনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। স্রষ্টার নীতি-কতৃত্ত্ব-পরকাল-বর্তমান কিছুই বাদ গেলোনা। কখনো তাকে মনে হচ্ছিল অতি নিষ্ঠাবান আস্তিক আবার পরক্ষনেই তিনি সংশয় ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। এরকম একজন মানুষের সামনে কি কথা নিয়ে দাড়ানো যায়! এসব যখন ভাবছিলাম তখন খুব সুন্দর করে মাহবুবুল আলম গোরা বললেন, হুমায়ুন ভাই আপনি তো বিজ্ঞানের ছাত্র, জীবনের বৈচিত্র-জীবন দর্শন সব নিয়ে বেশ ভাবেন। একটি বিষয় নিয়ে আমার প্রায়ই ভাবনা হয়, সেটা হচ্ছে স্বপ্ন! আচ্ছা বলুন তো স্বপ্নে আমরা আসলে কোথায় থাকি? স্বপ্নটা আসলে কী!
এটা কি ভার্চুয়াল কোন জগত না আসলে ক্ষণিকের জন্য আমরা অন্য কোথাও প্রত্যাবর্তিত হই। স্বপ্নে আমি প্রায়ই আমার মরহুমা মা’কে দেখি। তার সাথে অনেক কথা হয়। হুমায়ুন স্যার তন্ময় হয়ে মাহবুব ভাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। কোন উত্তর করলেন না। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- এ ইহ-জাগতিক অনেক কিছুরই ব্যখ্যা নেই মাহবুব ভাই। আমি খুব পুলক অনুভব করলাম। এর আগে স্যার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন “ ডিভাইন গাইডেন্স আবার কী, এটা কেন প্রয়োজন? আমার জ্ঞান আছে, মেধা আছে-সেটা দিয়ে আমি নিজের পথ ঠিক করবো। চাপিয়ে দেয়া গাইডেন্স কেন দরকার?” এবার সে কথার পূণ:সূত্র টেনে আমি কিছুটা বোকা সেজে বললাম, স্যার একটি বিষয়ে আমার ও খুব ভাবনা হয়, জবাব পাইনা। -কী সেটা? -আমার(নিজ হাত, মাথা দেখিয়ে) এ হাত-এ মাথা তো আমার, তাই না! তিনি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। -কিন্তু আমার হাত, মাথা বা অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলো সব-সময় তো আমার ডিরেকশন ফলো করেনা। -কেমন? আমি বললাম আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমার হাত-মাথা বা পেট কখনো কখনো ব্যথা করে, আমি চাইনা অথচ আমারই হাত-মাথা আমার প্রতিকূল আচরণ করে কেন? স্যার আবার আগের মত নিশ্চুপ হয়ে যান। কিছুটা ভেবে মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে বলেন আপনি খুব চালাক। এসব বিষয় নিয়ে একদিন সময় নিয়ে আসলে কথা বলবো। তারপর তিনি আমাদের কে অবাক করে দিয়ে বললেন যান আপনাদের জন্য একটি নাটক আমি দেব। মাহবুব ভাইয়ের হাত ধরে তিনি বললেন খুব ভালো লাগলো মাহবুব ভাই। মাঝে মাঝে আসলে গল্প করা যাবে। সেদিন তিনি আমাদের কে বাইরে এসে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন। আমরা সংকোচ করাতে স্মরণ করিয়ে দিলেন এটাতো নবীজির সুন্নাত।
সেবার ঈদের পূর্বে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে স্যার “আইনস্টাইন এবং” নামে একটি নাটক আমাদের কে তৈরী করে দিয়েছিলেন যা ছিল অবিশ্বাস্য। গত ঈদে স্যার আমাদের জন্য আরেকটি নাটক দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু শেষ মুহুর্তে শারীরীক অসুস্থতার জন্য দিতে পারেননি বলে মাহবুব ভাইকে ফোন করে সরি বলেছিলেন। এত বড় একজন মানুষের এ বদান্যতা সত্যিই ভুলার নয়। আমরা অবশ্য বেকায়দায় পড়ে অবশেষে তাকে কেন্দ্র করে “হুমায়ুনের মসনদ” নামে একটি নাটক করেছিলাম। মাহবুব ভাইয়ের অনুরোধে আমাকেই সে নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখতে হয়েছিল। স্যার শুনলে যাতে রাগ না করেন সেজন্য ডা: এজাজ কে আমরা হুমায়ুন চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলাম। আজ এসব ভেবে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে।

স্যার একবার ফোন করে তার সহকারী কে পাঠালেন আমাদের অফিসে। সে অনেক অব্যক্ত ইতিহাস, আমরা চেষ্টা করেছিলাম স্যারের পুরোনো পরিবার, তার মেয়েদের সাথে তার সম্পর্ক উন্নয়ন করার জন্য। স্যারের একান্ত ভক্ত দিগন্ত টেলিভিশনের হেড অব ব্রডকাস্ট আবুল হাসান এ ব্যপারে খুব অনুপ্রেরণা দিতেন আমাদের।
সবার অলক্ষে অনেক কষ্ট করেছিলাম আমরা। ডা: এজাজ ছিলেন এসব ব্যপারে খুব আন্তরিক কল্যানাকাংখী।
আজ সবই দূ:খময় স্মৃতি।
জীবনের কঠিন বাস্তবতায় হুমায়ুন আহমেদ আজ অতীত।
পরকালের যে অনিবার্য বাস্তবতা, তাতে তিনি কতটুকু সফল বা অসফল জানিনা। যে সংশয়ের দোলায় তিনি দোল খেতেন-ছিল কী সেখানে কোন অন্তিম উপলব্ধি?
তার কোন অপ্রকাশিত লেখায় হয়তো পাওয়া যাবে শেষ অনুভুতির ইংগিত।
চর্ম-চক্ষুর বিচার সাধারণের জন্য।
হুমায়ুন স্যার অসাধারণ-অন্যরকম একজন।
তার জন্য শুধু শুভ কামনা ছাড়া আজ আর কিছু-ই ভাবতে পারছিনা।
স্যার, আপনার ইহকালের মত পরকাল ও যদি গৌরবময় হয় তাহলে খুব, খু-উ-ব খুশী হবো।
জোহানেসবার্গ থেকে মাসুম বিল্লাহ লিখেছেন: আপনার ইহকালের মত পরকাল ও যদি গৌরবময় হয় তাহলে খুব, খু-উ-ব খুশী হবো।
ভাই আপনার এই কথার সাথে একমত হতে পারলাম না, কারন যারা জুগে জুগে ইসলামের জন্মে কষ্ট করছে তারা যখন যেয়ে দেখবে যে, ইসলামের পক্ষে কাজ না করেও সম্মান পাচ্ছে তাহলে সেই ত্যাগী জান্নাতি মানুষ টি নিশ্চয়ই জান্নাতে থেকেও খুসি হবে না, মনের অজান্তে পরকালের বিচারক কে অসম্মান করবেন, এবং পরকালের বিচারক হবেন শেরা বিচারক যে, কারো সাথে জুলুম করবেন না। আপনাদের মত ইসলামিক মানুষ গুলো যখন স ঘষিত নাস্তিক কে জান্নাতি করতে দুয়া করেন তখন, নতুন দের কে নাস্তিক বানাতে উৎসাহিত করে, কারন ভাবে মঞ্জু ভাই যখন বলছে ভাল মানুষ দুয়া করছে জান্নাতে দেখতে চাচ্ছে এবং দেখে খুসি হবে, তখন নতুন রা নাস্তিকদের অনুস্মরণ করে, ভাবে তাদের অনুস্মরণ করাটাই ঠিক, কারন এখানেও সফল পরকালেও সফল।
‎জবাব দিয়েছেন: লেখক: @ Masum Billah- ধন্যবাদ ভাই। একমত হতে না পারা, বা দ্বি-মত পোষন করা ইসলামের স্বাভাবিক সৌন্দর্য। অন্ধভাবে আবেগ বশত: কারো কথায় প্রভাবিত না হওয়াটাই ইসলামের শিক্ষা।
আল্লাহর রাসূল (স:) তার চাচা আবু তালিবের পরিচয়-আমল সব জেনেও তার মাগফিরাতের জন্য অনেক দোয়া করেছেন। রাসূল (স:) বলেছেন কিয়ামতের দিন আল্লাহ রাব্বুল আ”লামীন সেদৃশ্য দেখে হাসবেন যখন নিহত ব্যক্তি এবং খুনী উভয়েই হাত ধরাধরি করে বেহেশতে প্রবেশ করবে।
যে বিষয়টি নিয়ে আপনি একমত হতে পারেননি তার পূর্বাপর কিছু অংশ এখানে আবার কপি করলাম:
“জীবনের কঠিন বাস্তবতায় হুমায়ুন আহমেদ আজ অতীত।
পরকালের যে অনিবার্য বাস্তবতা, তাতে তিনি কতটুকু সফল বা অসফল জানিনা। যে সংশয়ের দোলায় তিনি দোল খেতেন-ছিল কী সেখানে কোন অন্তিম উপলব্ধি?
তার কোন অপ্রকাশিত লেখায় হয়তো পাওয়া যাবে শেষ অনুভুতির ইংগিত।
চর্ম-চক্ষুর বিচার সাধারণের জন্য।
হুমায়ুন স্যার অসাধারণ-অন্যরকম একজন।
তার জন্য শুধু শুভ কামনা ছাড়া আজ আর কিছু-ই ভাবতে পারছিনা।
স্যার, আপনার ইহকালের মত পরকাল ও যদি গৌরবময় হয় তাহলে খুব, খু-উ-ব খুশী হবো।”

হুমায়ুন আহমেদ একজন অসাধারণ মানুষ,তিনি সংশয়বাদী, চর্মচক্ষুর বিচার, হয়তো পাওয়া যাবে, অন্তিম উপলব্ধি, যদি গৌরবময় হয়-একথা গুলোর ইংগিত নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন।

তবে আপনার একটি বিষয়ের সাথে আমি দ্বিমত করছি সংগত কারণে, তা হলো-আপনার ভাষায়-“মনের অজান্তে পরকালের বিচারক কে অসম্মান করবেন।” প্রসঙ্গে।
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আল্লাহ রাব্বুল আ”লামীন যাকে খুশী তাকে ক্ষমা করবেন, জান্নাত দান করবেন। এটা তার এখতিয়ার। তিনি অন্তর্যামী, তিনি হাইয়্যুল কাইয়ুম।তার এখতিয়ার প্রসঙ্গে “মনের অজান্তে অসম্মান করার বিষয়টি আসলে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণেই কেবল ঘটতে পারে।
হজরত ফাতেমা কে উদ্দেশ্য করে রাসূল (স:) এর বিখ্যাত উক্তিটি নিশ্চয়ই মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, ফাতেমা শেষ বিচারের দিন কেউ তার আমল দিয়ে বেহেশতে যেতে পারেবেনা।ফাতেমা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ আপনি ও কী? তিনি বলেছিলেন হ্যা।
বেহেশতে সে-ই প্রবেশ করবে, আল্লাহ যাকে পছন্দ করবেন অথবা ক্ষমা করবেন।
আপনার দ্বিমতের জন্য আবারো ধন্যবাদ।

অত:পর মাসুম বিল্লাহ জবাব দিয়েছেন: ধন্যবাদ @ MOjibur Rahman Monju vai ভাই আপনাকে আমার ভান্ত ধারণা দূর করে দিয়ার জন্মে, আল্লাহ্‌ আমাকে ( আমাদের) ক্ষমা করুন।