হুমায়ুন আহমেদ! কিছু স্মৃতি ও শুভ কামনা।

মজিবুর রহমান মন্জু, ২০ জুলাই, শুক্রবার

Humayun_ahmed_writter

 

 

 

হুমায়ুন আহমেদ, নিজ কল্পনার আয়নায় যিনি বাদশাহ নামদার। অগণিত জনের একান্ত প্রিয় একজন মানুষ। তিনি আর নেই। চিরকালের জন্য ছেড়ে গেছেন আমাদের। একজন অসাধারণ মানুষের সগৌরব প্রস্থান। অনেক দিন থেকে তিনি জানান দিয়ে, আমাদেরকে মানসিক ভাবে প্রস্ত্তুত করে তারপর পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। যাবার আগে একবার নিজ দেশ, জন্মদাত্রী মা, এবং সকল শুভাকাংখীদের দেখে গেলেন দু’চোখ ভরে। শেষবার দেশে আসার পর,(মাস খানেক আগে)যখন দেয়াল উপন্যাস নিয়ে বেশ বিতর্ক হল তখন আমার সৌভাগ্য হয়েছে তার একটি টেলিফোন কল পাওয়ার। তাই কিছুতেই কষ্ট থামাতে পারছিনা। এখনো যেন কানে ভাসছে সে সহজ-সরল কথোপোকথন। সাহিত্যের মানুষ না হয়েও যিনি বাংলা সাহিত্যের পরম বন্ধু, কালের সম্রাট। বাংলাদেশে কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যের আধিপত্য ম্লান করে দিয়ে যিনি গল্প ও সাহিত্য প্রেমিক তরুণ-যুবা দের নিজ দেশের বই পড়ার আকর্ষণ তৈরী করেছেন। তাকে যারা পছন্দ-কিংবা অপছন্দ করেন, সম্ভবত: সবাই আজ খুব ব্যথিত। শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আহমেদ হাসতে হাসতে গেছেন কিনা জানিনা, তবে যাবার সময় তিনি সবাইকে কাদিয়েছেন। স্যার কে ঘিরে অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে আজ। বেশ কয়েক বছর আগে এক রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে হুমায়ুন আহমেদের বাসায় গিয়েছিলাম ঈদুল ফিতরের একটি নাটক প্রসঙ্গে আলাপের জন্য। আমার যে পরিচয় তাতে তিনি সহজাত স্বচ্ছন্দে তার বাসভবনে আমাকে গ্রহণ করার কথা নয়, প্রথমাবস্থায় করেন-ও নি। শুরুতেই তার তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞামূলক অভিব্যক্তি প্রকাশ পেল এবং তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন ঈদের নাটকে তিনি সহযোগিতা করবেন না। আমরা ছিলাম ৩জন। আমি, বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের বিখ্যাত মানুষ-কীর্তিমান কবি ও সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় মাহবুবুল আলম গোরা এবং জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী স্যারের স্নেহধন্য ডা: এজাজ। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত শ্রদ্ধেয় মাহবুব ভাইয়ের সৌজন্যে হুমায়ুন স্যার আমাদের বেশ গুরুত্ত্ব দিলেন এবং একপর্যায়ে গল্প খুব জমে উঠেলো। সেদিনই টের পেলাম হুমায়ুন আহমেদ কত আড্ডাপ্রিয় একজন মানুষ। আমাদের আড্ডায় একপর্যায়ে শামীল হলেন স্যারের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন-ও। সেদিনের সেই কথপোকথন, নানা মজার আলোচনা আমি কখনো ভুলবোনা। হুমায়ুন স্যার সেদিন(সম্ভবত: আমাকে দেখে) ইসলাম সম্পর্কে কনফিউশন(সংশয়) সৃষ্টি করতে পারে এমন বিষয়গুলো নিয়েই বেশী আলোচনা করলেন। তিনি যে কত প্রাজ্ঞ এবং বৈচিত্রময় জ্ঞানের ভান্ডার তা বাস্তবে অনুভব করলাম। আলোচনা অতি প্রাকৃতিক বিষয় থেকে গভীর দর্শনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। স্রষ্টার নীতি-কতৃত্ত্ব-পরকাল-বর্তমান কিছুই বাদ গেলোনা। কখনো তাকে মনে হচ্ছিল অতি নিষ্ঠাবান আস্তিক আবার পরক্ষনেই তিনি সংশয় ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। এরকম একজন মানুষের সামনে কি কথা নিয়ে দাড়ানো যায়! এসব যখন ভাবছিলাম তখন খুব সুন্দর করে মাহবুবুল আলম গোরা বললেন, হুমায়ুন ভাই আপনি তো বিজ্ঞানের ছাত্র, জীবনের বৈচিত্র-জীবন দর্শন সব নিয়ে বেশ ভাবেন। একটি বিষয় নিয়ে আমার প্রায়ই ভাবনা হয়, সেটা হচ্ছে স্বপ্ন! আচ্ছা বলুন তো স্বপ্নে আমরা আসলে কোথায় থাকি? স্বপ্নটা আসলে কী!
এটা কি ভার্চুয়াল কোন জগত না আসলে ক্ষণিকের জন্য আমরা অন্য কোথাও প্রত্যাবর্তিত হই। স্বপ্নে আমি প্রায়ই আমার মরহুমা মা’কে দেখি। তার সাথে অনেক কথা হয়। হুমায়ুন স্যার তন্ময় হয়ে মাহবুব ভাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। কোন উত্তর করলেন না। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- এ ইহ-জাগতিক অনেক কিছুরই ব্যখ্যা নেই মাহবুব ভাই। আমি খুব পুলক অনুভব করলাম। এর আগে স্যার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন “ ডিভাইন গাইডেন্স আবার কী, এটা কেন প্রয়োজন? আমার জ্ঞান আছে, মেধা আছে-সেটা দিয়ে আমি নিজের পথ ঠিক করবো। চাপিয়ে দেয়া গাইডেন্স কেন দরকার?” এবার সে কথার পূণ:সূত্র টেনে আমি কিছুটা বোকা সেজে বললাম, স্যার একটি বিষয়ে আমার ও খুব ভাবনা হয়, জবাব পাইনা। -কী সেটা? -আমার(নিজ হাত, মাথা দেখিয়ে) এ হাত-এ মাথা তো আমার, তাই না! তিনি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। -কিন্তু আমার হাত, মাথা বা অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলো সব-সময় তো আমার ডিরেকশন ফলো করেনা। -কেমন? আমি বললাম আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমার হাত-মাথা বা পেট কখনো কখনো ব্যথা করে, আমি চাইনা অথচ আমারই হাত-মাথা আমার প্রতিকূল আচরণ করে কেন? স্যার আবার আগের মত নিশ্চুপ হয়ে যান। কিছুটা ভেবে মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে বলেন আপনি খুব চালাক। এসব বিষয় নিয়ে একদিন সময় নিয়ে আসলে কথা বলবো। তারপর তিনি আমাদের কে অবাক করে দিয়ে বললেন যান আপনাদের জন্য একটি নাটক আমি দেব। মাহবুব ভাইয়ের হাত ধরে তিনি বললেন খুব ভালো লাগলো মাহবুব ভাই। মাঝে মাঝে আসলে গল্প করা যাবে। সেদিন তিনি আমাদের কে বাইরে এসে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন। আমরা সংকোচ করাতে স্মরণ করিয়ে দিলেন এটাতো নবীজির সুন্নাত।
সেবার ঈদের পূর্বে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে স্যার “আইনস্টাইন এবং” নামে একটি নাটক আমাদের কে তৈরী করে দিয়েছিলেন যা ছিল অবিশ্বাস্য। গত ঈদে স্যার আমাদের জন্য আরেকটি নাটক দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু শেষ মুহুর্তে শারীরীক অসুস্থতার জন্য দিতে পারেননি বলে মাহবুব ভাইকে ফোন করে সরি বলেছিলেন। এত বড় একজন মানুষের এ বদান্যতা সত্যিই ভুলার নয়। আমরা অবশ্য বেকায়দায় পড়ে অবশেষে তাকে কেন্দ্র করে “হুমায়ুনের মসনদ” নামে একটি নাটক করেছিলাম। মাহবুব ভাইয়ের অনুরোধে আমাকেই সে নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখতে হয়েছিল। স্যার শুনলে যাতে রাগ না করেন সেজন্য ডা: এজাজ কে আমরা হুমায়ুন চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলাম। আজ এসব ভেবে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে।

স্যার একবার ফোন করে তার সহকারী কে পাঠালেন আমাদের অফিসে। সে অনেক অব্যক্ত ইতিহাস, আমরা চেষ্টা করেছিলাম স্যারের পুরোনো পরিবার, তার মেয়েদের সাথে তার সম্পর্ক উন্নয়ন করার জন্য। স্যারের একান্ত ভক্ত দিগন্ত টেলিভিশনের হেড অব ব্রডকাস্ট আবুল হাসান এ ব্যপারে খুব অনুপ্রেরণা দিতেন আমাদের।
সবার অলক্ষে অনেক কষ্ট করেছিলাম আমরা। ডা: এজাজ ছিলেন এসব ব্যপারে খুব আন্তরিক কল্যানাকাংখী।
আজ সবই দূ:খময় স্মৃতি।
জীবনের কঠিন বাস্তবতায় হুমায়ুন আহমেদ আজ অতীত।
পরকালের যে অনিবার্য বাস্তবতা, তাতে তিনি কতটুকু সফল বা অসফল জানিনা। যে সংশয়ের দোলায় তিনি দোল খেতেন-ছিল কী সেখানে কোন অন্তিম উপলব্ধি?
তার কোন অপ্রকাশিত লেখায় হয়তো পাওয়া যাবে শেষ অনুভুতির ইংগিত।
চর্ম-চক্ষুর বিচার সাধারণের জন্য।
হুমায়ুন স্যার অসাধারণ-অন্যরকম একজন।
তার জন্য শুধু শুভ কামনা ছাড়া আজ আর কিছু-ই ভাবতে পারছিনা।
স্যার, আপনার ইহকালের মত পরকাল ও যদি গৌরবময় হয় তাহলে খুব, খু-উ-ব খুশী হবো।
জোহানেসবার্গ থেকে মাসুম বিল্লাহ লিখেছেন: আপনার ইহকালের মত পরকাল ও যদি গৌরবময় হয় তাহলে খুব, খু-উ-ব খুশী হবো।
ভাই আপনার এই কথার সাথে একমত হতে পারলাম না, কারন যারা জুগে জুগে ইসলামের জন্মে কষ্ট করছে তারা যখন যেয়ে দেখবে যে, ইসলামের পক্ষে কাজ না করেও সম্মান পাচ্ছে তাহলে সেই ত্যাগী জান্নাতি মানুষ টি নিশ্চয়ই জান্নাতে থেকেও খুসি হবে না, মনের অজান্তে পরকালের বিচারক কে অসম্মান করবেন, এবং পরকালের বিচারক হবেন শেরা বিচারক যে, কারো সাথে জুলুম করবেন না। আপনাদের মত ইসলামিক মানুষ গুলো যখন স ঘষিত নাস্তিক কে জান্নাতি করতে দুয়া করেন তখন, নতুন দের কে নাস্তিক বানাতে উৎসাহিত করে, কারন ভাবে মঞ্জু ভাই যখন বলছে ভাল মানুষ দুয়া করছে জান্নাতে দেখতে চাচ্ছে এবং দেখে খুসি হবে, তখন নতুন রা নাস্তিকদের অনুস্মরণ করে, ভাবে তাদের অনুস্মরণ করাটাই ঠিক, কারন এখানেও সফল পরকালেও সফল।
‎জবাব দিয়েছেন: লেখক: @ Masum Billah- ধন্যবাদ ভাই। একমত হতে না পারা, বা দ্বি-মত পোষন করা ইসলামের স্বাভাবিক সৌন্দর্য। অন্ধভাবে আবেগ বশত: কারো কথায় প্রভাবিত না হওয়াটাই ইসলামের শিক্ষা।
আল্লাহর রাসূল (স:) তার চাচা আবু তালিবের পরিচয়-আমল সব জেনেও তার মাগফিরাতের জন্য অনেক দোয়া করেছেন। রাসূল (স:) বলেছেন কিয়ামতের দিন আল্লাহ রাব্বুল আ”লামীন সেদৃশ্য দেখে হাসবেন যখন নিহত ব্যক্তি এবং খুনী উভয়েই হাত ধরাধরি করে বেহেশতে প্রবেশ করবে।
যে বিষয়টি নিয়ে আপনি একমত হতে পারেননি তার পূর্বাপর কিছু অংশ এখানে আবার কপি করলাম:
“জীবনের কঠিন বাস্তবতায় হুমায়ুন আহমেদ আজ অতীত।
পরকালের যে অনিবার্য বাস্তবতা, তাতে তিনি কতটুকু সফল বা অসফল জানিনা। যে সংশয়ের দোলায় তিনি দোল খেতেন-ছিল কী সেখানে কোন অন্তিম উপলব্ধি?
তার কোন অপ্রকাশিত লেখায় হয়তো পাওয়া যাবে শেষ অনুভুতির ইংগিত।
চর্ম-চক্ষুর বিচার সাধারণের জন্য।
হুমায়ুন স্যার অসাধারণ-অন্যরকম একজন।
তার জন্য শুধু শুভ কামনা ছাড়া আজ আর কিছু-ই ভাবতে পারছিনা।
স্যার, আপনার ইহকালের মত পরকাল ও যদি গৌরবময় হয় তাহলে খুব, খু-উ-ব খুশী হবো।”

হুমায়ুন আহমেদ একজন অসাধারণ মানুষ,তিনি সংশয়বাদী, চর্মচক্ষুর বিচার, হয়তো পাওয়া যাবে, অন্তিম উপলব্ধি, যদি গৌরবময় হয়-একথা গুলোর ইংগিত নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন।

তবে আপনার একটি বিষয়ের সাথে আমি দ্বিমত করছি সংগত কারণে, তা হলো-আপনার ভাষায়-“মনের অজান্তে পরকালের বিচারক কে অসম্মান করবেন।” প্রসঙ্গে।
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আল্লাহ রাব্বুল আ”লামীন যাকে খুশী তাকে ক্ষমা করবেন, জান্নাত দান করবেন। এটা তার এখতিয়ার। তিনি অন্তর্যামী, তিনি হাইয়্যুল কাইয়ুম।তার এখতিয়ার প্রসঙ্গে “মনের অজান্তে অসম্মান করার বিষয়টি আসলে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণেই কেবল ঘটতে পারে।
হজরত ফাতেমা কে উদ্দেশ্য করে রাসূল (স:) এর বিখ্যাত উক্তিটি নিশ্চয়ই মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, ফাতেমা শেষ বিচারের দিন কেউ তার আমল দিয়ে বেহেশতে যেতে পারেবেনা।ফাতেমা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ আপনি ও কী? তিনি বলেছিলেন হ্যা।
বেহেশতে সে-ই প্রবেশ করবে, আল্লাহ যাকে পছন্দ করবেন অথবা ক্ষমা করবেন।
আপনার দ্বিমতের জন্য আবারো ধন্যবাদ।

অত:পর মাসুম বিল্লাহ জবাব দিয়েছেন: ধন্যবাদ @ MOjibur Rahman Monju vai ভাই আপনাকে আমার ভান্ত ধারণা দূর করে দিয়ার জন্মে, আল্লাহ্‌ আমাকে ( আমাদের) ক্ষমা করুন।

One thought on “হুমায়ুন আহমেদ! কিছু স্মৃতি ও শুভ কামনা।

Leave a comment